অসহযোগ আন্দোলনের কারণ:
অসহযোগ আন্দোলনের কারণকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হল দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি জমে থাকা ভারতীয়দের ক্ষোভ এবং অপরটি হলো খিলাফত ইস্যু।
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য ভারতের অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভারত ব্রিটেনের কলোনি কান্ট্রি হওয়ায় তাদের সৈন্যদেরখাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্রিটেনের ভারত থেকে সরবরাহ করতো যার জন্য ভারতে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব দেখা দেয় এবং ভারতের বাজারে সমস্ত বস্তুর দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষকে একটি বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এর জন্য মানুষ ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়।
- কুখ্যাত রাওলাট আইন, জালিওনাবাগ এর হত্যাকান্ড ভারতবাসীকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।
- কেবলমাত্র লোক দেখানোর জন্য হান্টার কমিশনকে আনা এবং জেনারেল ডায়ারের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় ভারতবাসী ব্রিটিশ সরকারের আসল চেহারা দেখতে পায়।
- এই সমস্ত কারণে ভারতবাসী ব্রিটিশ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে থাকলেও খিলাফত সমস্যার জন্য প্রথমবার হিন্দু-মুসলিম একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা করে এবং খিলাফত সমস্যা অসহযোগ আন্দোলনের তাৎক্ষণিক কারণে পরিণত হয়।
খিলাফত সমস্যা:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার সাথে মিলিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজরা জয়লাভের পর তুর্কিকে ভেঙে দেয় এবং তুর্কি শাসক যাকে সমস্ত মুসলিমরা তাদের ধর্মগুরু মানতো সেই খালিফার পদকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার রাষ্ট্রের সীমা ও কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজ ক্ষুব্ধ হয় তার মধ্যে ভারতের মুসলিম সমাজে ছিল। 1919 সালের শওকত আলী ও মোহাম্মদ আলী (আলী ব্রাদার্স) খালিফার পদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য খিলাফত কমিটি গঠন করে। এইভাবে খিলাফত সমস্যা অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে।
1919 সালে অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্স যেটি দিল্লিতে হচ্ছিল সেখানে ব্রিটিশ সামগ্রী বয়কট করার কথা বলা হয়। খিলাফত কমিটির নেতারা এটাও বলেন যুদ্ধের পরে তুর্কি সাথে ব্রিটিশরা যাতে এমন ভাবে চুক্তি করে যাতে খলিফার মর্যাদা বজায় থাকে। এমন অবস্থায় অল ইন্ডিয়া খিলাফত কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট মহাত্মা গান্ধী একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হতে দেখে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
1920 সালের সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেসের কলকাতার অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, যার ভিত্তি ছিল,
- খিলাফত সমস্যা
- জালিওনাবাগ হত্যাকান্ড
- স্বরাজ
(অসহযোগ আন্দোলনের সূচনার দিন বালগঙ্গাধর তিলক এর মৃত্যু হয়।)
এরপরে 1920 সালের কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের কথা বলা হয় যেখানে 15 জন সদস্য থাকবে। যারা আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার কাজ করবে।
অসহযোগ আন্দোলনের বিস্তার:
গান্ধীজী এবং আলী ভাইরা সারা ভারতের ভ্রমণ করে ভারতবাসীদের আন্দোলনে যোগদান উৎসাহী করে। এই সময় হাজার হাজার স্টুডেন্ট সরকারি কলেজ ছেড়ে দেশীয় কলেজে ভর্তি হয় শুরু করে। বহু উকিল তাদের প্রাক্টিস বন্ধ করে দেয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, জহরলাল নেহেরু, মতিলাল নেহেরু প্রমূখ। বৈদেশিক বস্ত্রকে সর্বসমক্ষে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বালগঙ্গাধর তিলক স্বরাজ ফান্ড এক কোটি টাকা সংগ্রহ করে আন্দোলনের জন্য। আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেমন মেদিনীপুর, গান্টারে (অন্ধ্রপ্রদেশের একটি জায়গা) মানুষ ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আসামের চা শ্রমিকরা চাপাতলা বন্ধ করে দেয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্ট্রাইক ডাকা শুরু হয়।
এই আন্দোলনে ভারতের সর্ব শ্রেণীর মানুষ যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, ব্যবসায়ী শ্রেণি, কৃষকরা, ছাত্ররা, মহিলারা এবং বিশেষ করে মুসলিমরা।
আন্দোলনের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি:
ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলন থেকে গান্ধীজিকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে এবং তাতে তারা ব্যর্থ হলে সমস্ত প্রথম শ্রেণীর নেতাদের কে এরেস্ট করে, পাবলিক মিটিং কে ব্যান করে দেওয়া হয়, সংবাদপত্রের উপর তারা বিধি-নিষেধ আনে।
অসহযোগ আন্দোলনের শেষের পর্যায়:
1921 সালে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে হাকিম আজমাল খান সভাপতিত্ব করেন এবং গান্ধীজিকে আইন অমান্য আন্দোলনে সম্পূর্ণ ভার দেন। গান্ধীজী সরকারের সামনে প্রস্তাব রাখেন সমস্ত রাজকীয় বন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য এবং সংবাদপত্রের উপর থাকা বিধিনিষেধ উঠিয়ে দেওয়ার জন্য এবং সরকারকে জানান এটা না হলে তিনি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন। কিন্তু এই আইন অমান্য আন্দোলন আর শেষ পর্যন্ত শুরু হতে পারেনি।
কারণ ইতিমধ্যে 1922 সালে গোরখপুর এর চৌরিচৌরা নামক স্থানে কিছু মানুষ খাদ্যদ্রব্যের অত্যাধিক দাম এবং মদ বিক্রি নিয়ে আন্দোলন করা কালীন পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায় এতে উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে এবং সমস্ত পুলিশ পুলিশ স্টেশনে ঢুকে যায়। এরপর উত্তেজিত জনতা সেই পুলিশ স্টেশনে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং 22 জন পুলিশের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা চৌরিচৌরা ঘটনা নামে পরিচিত। আন্দোলনে এরকম হিংসা দেখে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা করেন।
গান্ধীজীর এই ঘটনায় তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা যেমন সুভাষচন্দ্র বোস, মতিলাল নেহেরু, জহরলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাশ সকলে অসম্মতি প্রকাশ করেন। যদিও তাতেও গান্ধীজী আন্দোলন বন্ধ করার তার ডিসিশন থেকে সরে আসেন না। এরপর গান্ধীজিকে 6 বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন