প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চলে 1914 থেকে 1919 পর্যন্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে তিনটি বিচারধারা দেখা যায়।
- নরমপন্থীরা ভাবে এই সময়ে ব্রিটিশদের সহায়তা করা উচিত।
- চরমপন্থীরা ভাবি এই সময় ব্রিটিশদের সহায়তা করলে হয়তো ব্রিটিশ সরকার ভারতকে সেলফগভর্নেন্স দিয়ে দেবে। বালগঙ্গাধর তিলক এমনটা ভাবছেন। এখানে বাল গঙ্গাধর তিলকের কথা বলা হচ্ছে কারণ 1914 তার 6 বছরের কারাদণ্ড শেষ হয়ে গিয়েছিল।
- রিভলিউশনারি অ্যাক্টিভিস্টরা ভাবে এটি আদর্শ সময় ব্রিটিশদের উপর আক্রমণ করার এবং তাদেরকে ভারত থেকে বিতাড়িত করার।
এরপরে গদর পার্টি এর চেষ্টাও করে তবে সেটি সফল হয়নি। এছাড়া কিছু বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা যায়, যেমন সিঙ্গাপুরে ভারতীয় সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তবে এই সময় কোন একটি সর্বভারতীয় আন্দোলন দেখা যায়নি।
হোমরুল আন্দোলন
হোমরুল এর ধারণাটি আয়ারল্যান্ড থেকে এসেছিল আর যাকে নিয়ে এসেছিলেন শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত। শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত 1896 সালে ভারতে আসেন থিওসফিক্যাল সোসাইটি মেম্বার হয়ে। ম্যাডাম ব্ল্যাভাস্কি এবং কর্নেল অলকোট 1875 সালে থিওসফিক্যাল সোসাইটি আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে থিওসফিক্যাল সোসাইটি চেন্নাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত অধ্যাত্মবাদ এর দিকে থাকলেও পরবর্তীকালে তিনি জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রীতে পরিণত হন।
অ্যানি বেসান্ত আইরিশ হওয়ায় তার হোমরুল আন্দোলনের সম্পর্কে যথেষ্ট সুস্পষ্ট ধারণা ছিল এবং ভারতীয় দুর্দশা দেখে তিনি ভারতীয় হোমরুল আন্দোলন শুরু করার প্রস্তাব রাখেন। ইতিমধ্যে বালগঙ্গাধর তিলক ভারতে চলে আসায় তিনিও হোমরুল আন্দোলনে অংশ নেন।
ভারতে আসার পর বালগঙ্গাধর তিলক কংগ্রেসের যোগ দিতে চান কিন্তু কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতারা চরমপন্থী বালগঙ্গাধর তিলক কে পুনরায় দলে নিতে রাজি ছিলেন না।
পরবর্তীকালে অ্যানি বেসান্ত এবং লোকমান্য তিলক কংগ্রেসের সদস্যপদ পেতে সফল হয়। এরপরে অ্যানি বেসান্ত বালগঙ্গাধর তিলক কংগ্রেসের সামনে হোমরুল আন্দোলনের প্রস্তাব রাখলে কংগ্রেস তাতে সম্মতি দেয় না এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয় যদি ছয় মাসের মধ্যে কংগ্রেস কোন রেজুলেশন পাশ না করতে পারে তাহলে শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত ও লোকমান্য তিলক তাদের নিজেদের ক্ষমতায় হোমরুল লীগ প্রচারণা করতে পারেন। পরবর্তী ছয় বয়সে কংগ্রেস রেজুলেশন পাশ করতে না পারায় অ্যানি বেসান্ত এবং লোকমান্য তিলক হোমরুল আন্দোলন শুরু করেন।
এই আন্দোলনের দুটি ভাগ ছিল- একটি ভাগকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক এবং অপরকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত।
বালগঙ্গাধর তিলক এর লিগ
1916 সালে বালগঙ্গাধর তিলক তার হোমরুল লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার হোমরুল লীগের হেডকোয়াটার ছিল পুনা। এবং তার কাজ করার জায়গা ছিল মহারাষ্ট্র (বোম্বে বাদে), কর্ণাটক, সেন্ট্রাল প্রভিন্স এবং বেরার।
বালগঙ্গাধর তিলক তিনটি জিনিসের উপর জোর দেন
- স্বরাজ
- ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠন
- দেশীয় ভাষায় শিক্ষাদান
অ্যানি বেসান্তের লীগ
অ্যানি বেসান্ত 1916 সালে অল ইন্ডিয়া হোমরুল লীগ প্রতিষ্ঠা করেন মাদ্রাসে। এই কাজে তাকে সহায়তা করেছিলেন জর্জ আরুন্ডেল, বি ডাব্লু ওয়াদিয়া ও সি আর রামাস্বামী আইয়ার। অ্যানি বেসান্ত হোমরুল লীগের 200 টি ব্রাঞ্চ ছিল সারা ভারতবর্ষে এবং বোম্বেতে একটি ব্রাঞ্চ ছিল।
অ্যানি বেসন্ট এর দুটি সংবাদপত্রের নাম ছিল নিউ ইন্ডিয়া এবং কম্মন উইল। যার মাধ্যমে তিনি হোমরুল এর বিচারধারা জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছাতেন।
বালগঙ্গাধর তিলক এবং অ্যানি বেসান্ত ছাড়াও বহু ভারতীয় নেতা হোমরুল লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মতিলাল নেহেরু, জহরলাল নেহেরু, ভুলাভাই দেসাই, চিত্তরঞ্জন দাস, মদনমোহন মালব্য, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, তেজ বাহাদুর শাহ প্রমুখ।
হোমরুল লীগের প্রোগ্রাম
যেহেতু হোমরুল এর ধারণাটি স্বদেশীর মতো সহজ ছিল না তাই সাধারণ মানুষকে হোমরুল সম্বন্ধে অবগত করানো হোমরুল লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। এর জন্য হোমরুল লীগ বিভিন্ন জায়গায় জনসমাবেশ করত, সংবাদপত্রে আর্টিকেল প্রকাশ করত, এবং বেশকিছু লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছিল।
হোমরুল আন্দোলনের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
ব্রিটিশ সরকার চরম দমননীতির মাধ্যমে হোমরুল আন্দোলনকে বন্ধ করার চেষ্টা করে। মাদ্রাজি যে সমস্ত জায়গায় ছাত্ররা হোমরুল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তাদেরকে রাজনৈতিক জনসভায় যোগ দিতে বাধা দেওয়া হয়। বালগঙ্গাধর তিলক কে পাঞ্জাব এবং দিল্লিতে ঢুকতে দেওয়া হয় না এবং তার বিরুদ্ধে একটি কেস করা হয়। 1917 সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সরকার অ্যানি বেসান্ত ও তার সহকারী বি পি ওয়াদিয়া এবং জর্জ অরুন্ডেলকে অ্যারেস্ট করে। এতে সমস্ত ভারতবাসীর বিদ্রোহী হয়ে যায় এবং অ্যানি বেসান্তকে মুক্ত করার জন্য। তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া লর্ড মন্টেগু ভারতবাসী এই বিদ্রোহী মনোভাব দেখে অ্যানি বেসান্তকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং 1917 সালের সেপ্টেম্বর মাসে অ্যানি বেসান্ত ছেড়ে দেওয়া হয়।
হোমরুল আন্দোলনের শিথিল হয়ে যাওয়ার কারণ
- অর্গানাইজেশন এর অভাব।
- অ্যানি বেসান্তকে এরেস্ট করার পর সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া মন্টেগু একটি রিফর্ম আর কথা বলেন যেটাকে আমরাও মন্টেগু-চেমসফোর্ড আমি জানি। আর এই রিফর্মের প্রতি কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতাদের আশাবাদী ছিলন এবং তারা এই কারণে হোমরুল আন্দোলন কে আর অগ্রসর করতে চাইনি।
- বালগঙ্গাধর তিলক কে 1918 সালে বিদেশে যেতে হলে আন্দোলনটি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে।
- অ্যানি বেসান্ত মন্টেগু-চেমসফোর্ড নিয়ে কনফিউজ ছিলেন, এই কারণে আন্দোলনে আর কোন সক্রিয় নেতা থাকে না এবং আন্দোলনটি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে, এবং 1919 আস্তে আস্তে আন্দোলনটি শিথিল হয়ে পড়ে।
গভারমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট 1919 বা মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিফর্ম
- সেন্ট্রাল লেজিসলেচার এবং প্রভিন্সিয়াল লেজিসলেচার তৈরির কথা বলা হয়।
- এই রিফর্মে ডুয়েল গভর্নেন্স বা ডাইয়ার্চি প্রতিষ্ঠান কথা বলা হয়।
- এই রিফর্মের বাইক্যামেরালিজাম কে ইন্ট্রোডিউস করা হয়। কাউন্সিল অফ স্টেট এবং লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের 6 জন সদস্যের মধ্যে তিনজন ভারতীয় হবে এমনটা এই রিফর্মে বলা হয়।
- কমিউনাল রিপ্রেজেন্টেশন দেওয়ার কথা বলা হয়। শিখ, ইন্ডিয়ান ক্রিশ্চান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ইউরোপিয়ানদের। যা এর আগে 1909 এ কেবলমাত্র মুসলিমদের তা দেওয়া হয়েছিল।
- পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- 10 বছর পরে একটি স্টাতুটরি কমিশন পাঠানো হবে, গভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট 1919 কেমন চললো তা দেখার জন্য তাও জানানো হয়।
হোমরুল আন্দোলনের পজিটিভ দিক
- হোমরুল আন্দোলন শহর এবং গ্রামের জনসাধারণকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাতে সক্ষম হয়েছিল।
- হোমরুল আন্দোলন করার ফলে জনসাধারণ রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত হয় এবং পরবর্তীকালে আন্দোলন গুলির জন্য তৈরি হয়ে যায়।
- 1916 সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তি।
লক্ষ্ণৌ চুক্তি
লক্ষ্ণৌ চুক্তি হয়েছিল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে 1916 সালে। যেখানে মুসলিম লীগ বলে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে মিলিত হয়ে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের সামনে দাবি জানাবে এবং জাতীয় কংগ্রেস বলে তারা মুসলীম লীগের জন্য সিট সংরক্ষণ করবে।
লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন অম্বিকাচরণ মজুমদার। এই অধিবেশনে কংগ্রেস এর দুটি পক্ষ নরমপন্থী এবং চরমপন্থীরা ও এক হয়ে যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন