বঙ্গভঙ্গ
1903 সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ সরকার সর্বসমক্ষে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব টি আনে। এতে তারা বলেন বাংলাকে ভাগ করে তারা দুটি প্রদেশ গঠন করবেন একটি পশ্চিমবঙ্গ যেখানে থাকবে বাংলার কিছু অংশ বিহার এবং উড়িষ্যা (যার রাজধানী হবে কলকাতা) এবং অপর একটি ভাগ হবে পূর্ববঙ্গ হিসেবে যার মধ্যে থাকবে বাংলার বাকি অংশ এবং আসাম (যা রাজধানী হবে ঢাকা)। এই বঙ্গভঙ্গের কারণ হিসাবে ব্রিটিশ সরকার জানায়, 78 লক্ষ জনসাধারণের শাসন কার্য চালানো কঠিন এবং এই বঙ্গভঙ্গের ফলে আসামের উন্নতি হবে।
এই যুক্তি কিছু অংশের ঠিক হলেও ব্রিটিশ সরকারের আসল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বাংলাকে দুটি অংশে বিভক্ত করে দিয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে কম জোর করে দাও।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন
বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই সমস্ত জাতীয় নেতারা জনসাধারণকে এর বিরোধিতা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে তাদের লেখনীর দ্বারা। যেমন হিতবাদী, সঞ্জীবনী (সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র), বেঙ্গলি (সম্পাদক ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রভৃতি দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা গুলিতে নিয়মিত বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আর্টিকেল প্রকাশিত হতো। কৃষ্ণকুমার মিত্র সর্বপ্রথম তার সঞ্জীবনী পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করা হয়েছিল দেশীয় নেতাদের দ্বারা।
এরপর 1905 সালের আগস্ট মাসের 7 তারিখে বিদেশি পণ্য বর্জনের কথা এবং স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের কথা জানানো হয় এবং বয়কট এবং স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়।
1905 সালের অক্টোবর মাসের 16 তারিখ অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের দিন সারা বাংলার মানুষ উপবাস করেন গঙ্গাস্নান করেন এবং ভাতৃত্ববোধের প্রমাণ স্বরূপ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সকলকে রাখি পরানো। এই দিনে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি এবং আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে একটি বিরাট জনসমাবেশের আয়োজন হয় এবং মাত্র কিছু ঘণ্টার মধ্যেই সেখান থেকে 50 হাজার টাকা এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য সংগ্রহ করা হয়।
প্রতিবারের মতো এবারও কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতারা রেজুলেশন পাশ করে এবং কনস্টিটিউশনাল পথে এর বিরোধিতা জানানোর কথা জানান তবে 1905 পর্যন্ত আস্তে আস্তে কংগ্রেসে একদল চরমপন্থী নেতার আবির্ভাব হয় যাদের জনপ্রিয়তা ছিল খুবই বেশি তাদের মধ্যে ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রাই, বিপিনচন্দ্র পাল এবং অরবিন্দ ঘোষ। কংগ্রেসের এই সমস্ত চরমপন্থি নেতারা প্যাসিভ রেজিস্টেন্স এবং বয়কট এ কথা জানান এবং বাংলায় স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
স্বদেশী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বাংলার জনসাধারণ সমস্ত বৈদেশিক জিনিস বর্জন করার ফলে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দরকার পড়ে এবং তার জন্য তৈরি হয় অনেকগুলি দেশীয় কারখানা যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,
- বেঙ্গল কেমিক্যালস- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে তৈরি হয়।
- জাতীয় সাবান কারখানা- ডঃ নীলরতন সরকারের উদ্যোগে তৈরি হয়।
- লৌহ ইস্পাত কারখানা- জামসেদজী টাটা তৈরি করেন।
- এন্টি সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন শচীন্দ্র প্রসাদ বসু।
স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশীয় শিক্ষার প্রসার-
- 1905 সালে আট নভেম্বর রংপুরে সর্বপ্রথম জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
- 1906 সালে 11 ই মার্চ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে এক সভায় 92 জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।
- 14 ই আগস্ট এই পরিষদের অধীনে অরবিন্দ ঘোষকে অধ্যক্ষ করে কলকাতায় বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- 1908 সালের মধ্যে বাংলায় প্রায় পঁচিশটি মাধ্যমিক এবং 300 টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
এই সময় বাংলা কিছু বিপ্লবী দলের প্রতিষ্ঠিত হয়, যেমন- অনুশীলন সমিতি (1902)- পি মিত্র, ঢাকা অনুশীলন সমিতি (1907)- পুলিনবিহারী দাস, যুগান্তর দল এবং যুগান্তর পত্রিকা 1906 সালে।
স্বদেশী আন্দোলনে জনসমর্থন
এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যোগ দিয়েছিলেন ছাত্র থেকে শুরু করে মহিলা, মুসলিম সম্প্রদায় এবং কৃষক শ্রেণী পর্যন্ত।
স্বদেশী আন্দোলনের কিছু মুসলিম নেতা হলেন আব্দুল রসুল, মৌলভী লিয়াকত হোসেন, আবুল কাশেম।
সুরাট বিচ্ছেদ (1907)
বাংলায় যখন এরকম তীব্র আন্দোলনের শুরু হয় তখন কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতারা এই আন্দোলনকে সর্বভারতীয় করতে চায় কিন্তু কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতা তখনও পর্যন্ত এরকম কোন আন্দোলন করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
1905 সালে কংগ্রেসের অধিবেশন হয় বারাণসীতে যেখানে প্রেসিডেন্ট বানানো হয় গোপালকৃষ্ণ গোখলে কে এখানে চরমপন্থীরা নিজেদের দিক থেকে প্রেসিডেন্ট চেয়েছিল।ওই সময় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট যিনি হতেন কংগ্রেসের রেজুলিউশনের উপর তার চিন্তাধারার প্রভাব পড়তে।
এরপর 1906 সালে আবারো চরমপন্থীরা নিজেদের দিক থেকে লালা লাজপত রায় বা বালগঙ্গাধর তিলক কে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছিল কিন্তু নরমপন্থী দাদাভাই নওরোজি নাম প্রস্তাবিত করায় 1906 সালে কলকাতা অধিবেশনেও চরমপন্থীরা সভাপতিত্ব করতে পারেন দাদাভাই নওরোজি একজন অতি সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন সকলের কাছে।
যদিও এবার চরমপন্থীরা তাদের চিন্তাভাবনা কংগ্রেসের রেজুলেশনে নিয়ে আসে এবং দাদাভাই নৌরজি কংগ্রেসের অধিবেশনে স্বরাজের দাবি জানান যদিও স্বরাজ বলতে এখানে কি বলা হয়েছে স্বরাজের সংজ্ঞা সেখানে স্পষ্ট করে জানানো হয়নি। (বালগঙ্গাধর তিলক এর মত স্বরাজ ছিল self-governmence অরবিন্দ ঘোষের স্বরাজ ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা।)
এরপর 1907 সালে সুরাট অধিবেশন চরমপন্থীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে থাকে এবং নিজেদের দিক থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বালগঙ্গাধর তিলক বা লালা লাজপত রায়কে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চাই। অপরদিকে কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতারা বালগঙ্গাধর তিলক কে সভাপতিত্ব থেকে সরানোর জন্য সুরাট অধিবেশনের দাবি জানান নিয়ম অনুযায়ী কোন নেতা তার নিজস্ব জায়গায় হওয়া অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে পারে না এর ফলে জনপ্রিয় বালগঙ্গাধর তিলক নিজে থেকেই সভাপতিত্বে পর থেকে বাদ হয়ে যায়। এরপর ও চরমপন্থি নেতারা তাদের দিক থেকে কোন সভাপতি কে দেখতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু এবার নরমপন্থী রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেন। কিন্তু পূর্বের দুটি অধিবেশনের মত এবারকার নরমপন্থীদের সভাপতি অতটা জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন না যে চরমপন্থীরা নিজেদের পক্ষ ছেড়ে দেয়। এই কারণে সুরাট 1907 সালে কংগ্রেস দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
এরপরে কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতাদের তাদের পূর্বের পন্থায় ফিরে যায়।
সুরাট বিচ্ছেদ পর সরকারের কার্যকলাপ-
সুরাট বিচ্ছেদের পর কংগ্রেস দুর্বল হয়ে যায় এবং সরকার চরমপন্থীদের কে প্রবলভাবে দমন করার চেষ্টা করে। এর জন্য সরকার বিভিন্ন আইন নিয়ে আসে যেমন,
- সিডিসিএস মিটিং অ্যাক্ট- 1907
- ইন্ডিয়া নিউজ পেপার এক্ট- 1908
- ক্রিমিনাল ল আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট- 1908
- ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট- 1910
1908 সালে বালগঙ্গাধর তিলক এর ওপর রাজদ্রোহের আরোপ লাগানো হয় তার কেশরী পত্রিকার মুজাফফরপুর বোমা মামলা নিয়ে লেখার জন্য এবং তার 1000 টাকা জরিমানা করা হয় এবং তাকে ছয় বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয় বার্মার জেলে।
এরপর বিপিনচন্দ্র পাল এবং অরবিন্দ ঘোষ সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসেন এবং লাজপত রায় বিদেশে চলে যান। এর ফলে চরমপন্থী বিচারধারা শিথিল হয়ে পড়ে।
1909 এর মারলে মিন্টো রিফর্ম বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট অফ 1909-
ভাইসরয় লর্ড মিন্টো এবং সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া লর্ড মারলে এর নাম অনুসারে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট অফ 1909 কে মারলে মিন্টো রিফর্মস বলা হয়।
- এই আইনে প্রথমবার মুসলিমদের জন্যয আলাদা ইলেকশনের ব্যবস্থা করা হয়।
- এবং প্রথম কোন ভারতীয় সদস্য কে ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সির সদস্য বানানো হয়। যিনি ছিলেন সত্যেন্দ্র প্রসাদ সিনহা।
- ভারতীয়দের বাজেটের সাপ্লিমেন্টারি কোশ্চেন করার অনুমতি দেওয়া হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে ভোটাধিকার দেওয়া হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন